মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির সমালোচনা করছে কেন?
ফাঁসিতে বিশ্বাসি দেশগুলো
আমি ফাঁসি বিরোধী মানুষ। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের বাঁচার অধিকার আছে। প্রতিটি যুদ্ধাপরাধীর বিচার হওয়া উচিত। ফাঁসির বদলে অন্য যে কোনও শাস্তি তারা পেতে পারে। যাবজ্জীবন? নয় কেন? অবশ্য আজকাল আমি যাবজ্জীবনেও আপত্তি করি। জেলখানা ব্যাপারটাকেই আমি পছন্দ করি না। জেলখানাগুলো হতে পারে সংশোধনী কেন্দ্র। যতদিন মাথার কুচুটে কীটগুলো মরে যাচ্ছে, বা মাথা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, ততদিন অপরাধীরা থাকবে ওই কেন্দ্রে। কে যেন একজন বলেছিলেন, ‘জেলখানার ঘরগুলো হতে পারে এক একটা ক্লাসরুম, আর জেলখানাগুলো এক একটা বিশ্ববিদ্যালয়’। কিছুদিন আগে সুইডেনের কিছু জেলখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে, কারণ জেলে মোটে লোক নেই। অপরাধের সংখ্যা কম, তাই আসামীর সংখ্যাও কম। সমাজটাকে বৈষম্যহীন যত করা যায়, যত সমতা আনা যায় মানুষে-মানুষে, অপরাধ তত কমে যায়। সে সুইডেনের ব্যাপার, বাংলাদেশ তো আর সভ্য হয়নি, জেলখানা বন্ধ করে দেওয়ার স্বপ্ন না হয় আপাতত থাকুক। অন্য কথা বলি।
বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে বলছে, বলুক। তারা সারা পৃথিবীর যে দেশেই মৃত্যুদণ্ডের আইন আছে, সেই দেশকেই বলছে, ‘মৃত্যুদণ্ডের আইন বাতিল করো’। কিন্তু আমার প্রশ্ন, যে দেশগুলো মৃত্যুদণ্ডের আইন বহাল রেখেছে, নিজেরাও মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে ঘনঘন, সেই দেশগুলো বাংলাদেশের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে অত অশ্রু বিসর্জন করছে কেন? তারা কি অন্য কোনও দেশে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে এমন হামলে পড়ে, এমন মড়াকান্না কাঁদে? তারা কি চীনের বা সৌদি আরবের বা ইরানের বা আমেরিকার বা উত্তর কোরিয়ার চৌকাঠে নাছোড়বান্দার মতো এমন বসে থাকে? বাংলাদেশে অন্য কারও ফাঁসি হলে তো এদের চেহারা দেখা যায় না। তবে কি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি বলেই এত হাহাকার? মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী মৌলবাদী বলে? আর যাকেই মারো, ইসলামী মৌলবাদীর গায়ে আঁচড় কাটতে পারবে না! মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী যুদ্ধাপরাধী এ কথা কেউ বলছো না কেন! আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের খুনীদের বিচারে নানা দেশের শোক দেখে স্তম্ভিত হই। মৌলবাদী অপশক্তির বন্ধুর সংখ্যা কম নয় আজ সারা বিশ্বে। যে পশ্চিমী দেশগুলোকে ইসলামের শত্রু বলে ভাবা হতো, তারাও দেখা যায় ইসলামী মৌলবাদীদের প্রতি অস্বাভাবিকরকম সহানুভূতিশীল। আমার আর ইচ্ছে করে না ভাবতে কী কী রাজনীতি আছে মৌলবাদসমর্থনের পেছনে। একাত্তরের যুদ্ধকে মৌলবাদসমর্থক পশ্চিমী গোষ্ঠী যুদ্ধই মনে করতে চায় না। যেন গরিব দেশের যুদ্ধ কোনও যুদ্ধ নয়, তিরিশ লক্ষ মানুষের মরে যাওয়া কোনও মরে যাওয়া নয়, দু’লক্ষ মেয়ের ধর্ষণ কোনও ধর্ষণ নয়। যেন আমাদের দুর্ভিক্ষ, আমাদের ক্ষুধা, আমাদের অভাব, অশিক্ষাই সত্য, আর কিছু সত্য নয়। যেন আমাদের ভাষা, আমাদের গান, ভালোবাসা, আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের সাহস, আমাদের আশা আকাংখা, স্বপ্ন কিছুই সত্য নয়, মূল্যবান নয়।
আমি মৃত্যুদণ্ডে কেন বিশ্বাস করি না, তা বলছি। কোনও প্রাণীই বা কোনও মানুষই অপরাধী বা সন্ত্রাসী হয়ে জন্ম নেয় না। একটি শিশুকে যদি সুস্থ সুন্দর শিক্ষিত পরিবেশ দেওয়া না হয়, একটি শিশুর গড়ে ওঠার সময় যদি তার মস্তিস্কে ক্রমাগত আবর্জনা ঢালা হতে থাকে, তবে এই শিশুরাই বড় হয়ে অপরাধে আর সন্ত্রাসে নিজেদের জড়ায়। এ কি ওদের দোষ? নাকি যারা আবর্জনা ঢালে, আবর্জনা ঢালার যে প্রথা যারা চালু রাখছে সমাজে, তাদের দোষ! একই সমাজে বাস করে আমি মৌলবাদ বিরোধী, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বা দেলওয়ার হোসেন সাইদি মৌলবাদী, কেউ খুনী, ধর্ষক, চোর, আবার কেউ সৎ, সজ্জন। সমাজ এক হলেও শিক্ষা ভিন্ন বলেই এমন হয়। একদল লোক বিজ্ঞান শিক্ষা পাচ্ছে, মানবাধিকার সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করছে, আলোকিত হচ্ছে। আরেক দলকে ধর্মান্ধ, মূর্খ, কূপমণ্ডুক আর বর্বর বানানো হচ্ছে, ফেলে রাখা হচ্ছে ঘোর অন্ধকারে। শিক্ষার ব্যবস্থাটা সবার জন্য সমান হলে, শিক্ষাটা সুস্থ শিক্ষা হলে, সমানাধিকারের শিক্ষা হলে, মানুষেরা মন্দ না হয়ে ভালো হতো। ছোটখাটো অভদ্রতা, অসভ্যতা, টুকিটাকি অপরাধ থাকলেও সমাজ এমনভাবে নষ্টদের দখলে চলে যেতো না, এত লক্ষ লক্ষ লোক খুনের পিপাসা নিয়ে রাজপথে তাণ্ডব করতো না। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর জন্য বিদেশের কয়েকজন কাঁদলেই আঁতকে উঠি, কিন্তু দেশের লোকেরা যে উন্মাদ হয়ে উঠেছে কাদের-প্রেমে? এরাই তো এক একজন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। এক মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু হাজার হাজার মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী যে বিজ্ঞানমনস্ক মৌলবাদ-বিরোধী মানুষদের গলা কাটছে, তাদের কী করা হবে? গুটিকয় মৃত্যুপথযাত্রী অথর্ব যুদ্ধপরাধীর চেয়েও লক্ষ লক্ষ ইসলামী মৌলবাদী নিসঃন্দেহে ভয়ংকর। তারা আজ যুদ্ধপরাধী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক একজন সৈনিক।
যে দেশে সবার জন্য খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য নেই, সেই দেশে অরাজকতা থাকেই। অন্য সব ব্যবস্থার মতোই বিচার ব্যবস্থাতেও আছে গলদ। সে কারণেই অপরাধ করলে কী কারণে অপরাধ করেছে, কোথায় ভুল ছিল এসব না ভেবে, ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা না করে অপরাধীকে জেলে ভরা হয়, মেরে ফেলা হয়। ফাঁসি দিয়ে অনেক সমস্যার চলজলদি সমাধান করতে চায় সরকার। কিন্তু একে সমস্যার সত্যিকারের সমাধান হয় না। আমি ভবিষ্যতের কথা ভাবি, মৌলবাদী অপশক্তির অবসান চাই। অবসান ফাঁসি দিয়ে হয় না, এই অবসান সুশিক্ষা দিয়ে করতে হয়।
সমাজকে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, নারীবিদ্বেষ থেকে মুক্ত করতে হলে মানুষকে শিশুকাল থেকেই শিক্ষা দিতে হবে বিজ্ঞান, মানববাদ, সমানাধিকার। এই শিক্ষা পেলে শিশুদের ধর্মান্ধ, ধর্ষক আর খুনী হওয়ার আশংকা থাকে না।
জামাতে ইসলামির লোকেরা যে ভয়ংকর বর্বরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশে, তা দেখে আমি অবাক হইনি। কারণ আমি অনেক বছর থেকেই জানি যে জামাতে ইসলামি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত হলেও এটি একটি সন্ত্রাসী দল ছাড়া কিছু নয়। এদের রাজনীতি ঘৃণার, বৈষম্যের, অন্ধত্বের, অকল্যাণের, পঙ্গুত্বের, হত্যার। এই রাজনীতিকে সমাজে প্রবেশের করার সুযোগ দিলে এই রাজনীতি মানুষকে, দেশকে, দেশের ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে দেবে। খুব সংগত কারণেই জামাতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত। পৃথিবীর সব দেশেই সন্ত্রাসী দল নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করতে গেলে ‘গেল রে গেল রে’ বলে ছুটে এসে বাধা দেয় অনেকেই। যে দল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, সেই দলকে গণতন্ত্রের নামে বাঁচিয়ে রাখবো আর হাসতে হাসতে সে আপনার রগ কাটবে, আমার গলা কাটবে—এ আমরা জানি। জেনেও না জানার ভান আর কেউ করলেও আমি করি না। বাংলাদেশকে একটা ধর্মীয় মৌলবাদীতে ঠাসা, অনুন্নত, অশিক্ষিত, ধর্মান্ধ দেশ হিসেবে তৈরী করার বাসনা দেশের এবং দেশের বাইরের অনেকেরই যথেষ্ট। আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় প্রচণ্ড বিশ্বাসী হয়েও একটি দলকে নিষিদ্ধ করতে চাইছি, কারণ জামাতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য নয়।
যুদ্ধপরাধীরা প্রায় সবাই ইসলামী মৌলবাদী। মৌলবাদী-যুদ্ধপরাধী বা ইসলামী মৌলবাদীদের খুব বড় শত্রু আমি। তারা আমাকে খুন করার জন্য আজ একুশ বছর হলো ছুরিতে শান দিচ্ছে। হাতের কাছে পেলেই আমাকে জবাই করবে। এটা জেনেও আমি কিন্তু ওদের কারো ফাঁসি চাইছি না। ওরা ভালো মানুষ হোক, চাইছি। ওদের সন্তানেরা প্রগতির পক্ষের মানুষ হোক, চাইছি। ওদের সন্তানের সন্তানেরা যেন না জানে ধর্মান্ধ মৌলবাদ কাকে বলে, যেন সবাই একটা শ্রেণীহীন, বৈষম্যহীন, কুসংস্কারহীন সুন্দর পরিবেশ পায় বাস করার। সব মানুষ, এবং সব সন্তানই যেন পায়। সেই স্বপ্নের জন্য লড়াই আমার। আমি ওই সমতার সমাজ বেঁচে থাকতে দেখতে পারবো না, কিন্তু আমি সামান্য ভূমিকা রাখতে চাই সেই সুস্থ সমাজ গড়ায়, তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েও লিখছি, মানুষকে লড়াই করার প্রেরণা দিচ্ছি। যে দেশকে আজ দেশ বলে মনে হয় না, যে দেশ নিয়ে আজ লজ্জা হয়, চাইছি, সেই দেশ নিয়ে ভবিষ্যতের মানুষেরা গর্ব করুক। রক্তাক্ত রাজপথ নিয়ে নয়, একটি নিরাপদ স্বদেশ নিয়ে গর্ব।
ফাঁসিতে বিশ্বাসি দেশগুলো
আমি ফাঁসি বিরোধী মানুষ। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের বাঁচার অধিকার আছে। প্রতিটি যুদ্ধাপরাধীর বিচার হওয়া উচিত। ফাঁসির বদলে অন্য যে কোনও শাস্তি তারা পেতে পারে। যাবজ্জীবন? নয় কেন? অবশ্য আজকাল আমি যাবজ্জীবনেও আপত্তি করি। জেলখানা ব্যাপারটাকেই আমি পছন্দ করি না। জেলখানাগুলো হতে পারে সংশোধনী কেন্দ্র। যতদিন মাথার কুচুটে কীটগুলো মরে যাচ্ছে, বা মাথা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, ততদিন অপরাধীরা থাকবে ওই কেন্দ্রে। কে যেন একজন বলেছিলেন, ‘জেলখানার ঘরগুলো হতে পারে এক একটা ক্লাসরুম, আর জেলখানাগুলো এক একটা বিশ্ববিদ্যালয়’। কিছুদিন আগে সুইডেনের কিছু জেলখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে, কারণ জেলে মোটে লোক নেই। অপরাধের সংখ্যা কম, তাই আসামীর সংখ্যাও কম। সমাজটাকে বৈষম্যহীন যত করা যায়, যত সমতা আনা যায় মানুষে-মানুষে, অপরাধ তত কমে যায়। সে সুইডেনের ব্যাপার, বাংলাদেশ তো আর সভ্য হয়নি, জেলখানা বন্ধ করে দেওয়ার স্বপ্ন না হয় আপাতত থাকুক। অন্য কথা বলি।
বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে বলছে, বলুক। তারা সারা পৃথিবীর যে দেশেই মৃত্যুদণ্ডের আইন আছে, সেই দেশকেই বলছে, ‘মৃত্যুদণ্ডের আইন বাতিল করো’। কিন্তু আমার প্রশ্ন, যে দেশগুলো মৃত্যুদণ্ডের আইন বহাল রেখেছে, নিজেরাও মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে ঘনঘন, সেই দেশগুলো বাংলাদেশের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে অত অশ্রু বিসর্জন করছে কেন? তারা কি অন্য কোনও দেশে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে এমন হামলে পড়ে, এমন মড়াকান্না কাঁদে? তারা কি চীনের বা সৌদি আরবের বা ইরানের বা আমেরিকার বা উত্তর কোরিয়ার চৌকাঠে নাছোড়বান্দার মতো এমন বসে থাকে? বাংলাদেশে অন্য কারও ফাঁসি হলে তো এদের চেহারা দেখা যায় না। তবে কি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি বলেই এত হাহাকার? মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী মৌলবাদী বলে? আর যাকেই মারো, ইসলামী মৌলবাদীর গায়ে আঁচড় কাটতে পারবে না! মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী যুদ্ধাপরাধী এ কথা কেউ বলছো না কেন! আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের খুনীদের বিচারে নানা দেশের শোক দেখে স্তম্ভিত হই। মৌলবাদী অপশক্তির বন্ধুর সংখ্যা কম নয় আজ সারা বিশ্বে। যে পশ্চিমী দেশগুলোকে ইসলামের শত্রু বলে ভাবা হতো, তারাও দেখা যায় ইসলামী মৌলবাদীদের প্রতি অস্বাভাবিকরকম সহানুভূতিশীল। আমার আর ইচ্ছে করে না ভাবতে কী কী রাজনীতি আছে মৌলবাদসমর্থনের পেছনে। একাত্তরের যুদ্ধকে মৌলবাদসমর্থক পশ্চিমী গোষ্ঠী যুদ্ধই মনে করতে চায় না। যেন গরিব দেশের যুদ্ধ কোনও যুদ্ধ নয়, তিরিশ লক্ষ মানুষের মরে যাওয়া কোনও মরে যাওয়া নয়, দু’লক্ষ মেয়ের ধর্ষণ কোনও ধর্ষণ নয়। যেন আমাদের দুর্ভিক্ষ, আমাদের ক্ষুধা, আমাদের অভাব, অশিক্ষাই সত্য, আর কিছু সত্য নয়। যেন আমাদের ভাষা, আমাদের গান, ভালোবাসা, আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের সাহস, আমাদের আশা আকাংখা, স্বপ্ন কিছুই সত্য নয়, মূল্যবান নয়।
আমি মৃত্যুদণ্ডে কেন বিশ্বাস করি না, তা বলছি। কোনও প্রাণীই বা কোনও মানুষই অপরাধী বা সন্ত্রাসী হয়ে জন্ম নেয় না। একটি শিশুকে যদি সুস্থ সুন্দর শিক্ষিত পরিবেশ দেওয়া না হয়, একটি শিশুর গড়ে ওঠার সময় যদি তার মস্তিস্কে ক্রমাগত আবর্জনা ঢালা হতে থাকে, তবে এই শিশুরাই বড় হয়ে অপরাধে আর সন্ত্রাসে নিজেদের জড়ায়। এ কি ওদের দোষ? নাকি যারা আবর্জনা ঢালে, আবর্জনা ঢালার যে প্রথা যারা চালু রাখছে সমাজে, তাদের দোষ! একই সমাজে বাস করে আমি মৌলবাদ বিরোধী, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বা দেলওয়ার হোসেন সাইদি মৌলবাদী, কেউ খুনী, ধর্ষক, চোর, আবার কেউ সৎ, সজ্জন। সমাজ এক হলেও শিক্ষা ভিন্ন বলেই এমন হয়। একদল লোক বিজ্ঞান শিক্ষা পাচ্ছে, মানবাধিকার সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করছে, আলোকিত হচ্ছে। আরেক দলকে ধর্মান্ধ, মূর্খ, কূপমণ্ডুক আর বর্বর বানানো হচ্ছে, ফেলে রাখা হচ্ছে ঘোর অন্ধকারে। শিক্ষার ব্যবস্থাটা সবার জন্য সমান হলে, শিক্ষাটা সুস্থ শিক্ষা হলে, সমানাধিকারের শিক্ষা হলে, মানুষেরা মন্দ না হয়ে ভালো হতো। ছোটখাটো অভদ্রতা, অসভ্যতা, টুকিটাকি অপরাধ থাকলেও সমাজ এমনভাবে নষ্টদের দখলে চলে যেতো না, এত লক্ষ লক্ষ লোক খুনের পিপাসা নিয়ে রাজপথে তাণ্ডব করতো না। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর জন্য বিদেশের কয়েকজন কাঁদলেই আঁতকে উঠি, কিন্তু দেশের লোকেরা যে উন্মাদ হয়ে উঠেছে কাদের-প্রেমে? এরাই তো এক একজন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। এক মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু হাজার হাজার মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী যে বিজ্ঞানমনস্ক মৌলবাদ-বিরোধী মানুষদের গলা কাটছে, তাদের কী করা হবে? গুটিকয় মৃত্যুপথযাত্রী অথর্ব যুদ্ধপরাধীর চেয়েও লক্ষ লক্ষ ইসলামী মৌলবাদী নিসঃন্দেহে ভয়ংকর। তারা আজ যুদ্ধপরাধী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক একজন সৈনিক।
যে দেশে সবার জন্য খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য নেই, সেই দেশে অরাজকতা থাকেই। অন্য সব ব্যবস্থার মতোই বিচার ব্যবস্থাতেও আছে গলদ। সে কারণেই অপরাধ করলে কী কারণে অপরাধ করেছে, কোথায় ভুল ছিল এসব না ভেবে, ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা না করে অপরাধীকে জেলে ভরা হয়, মেরে ফেলা হয়। ফাঁসি দিয়ে অনেক সমস্যার চলজলদি সমাধান করতে চায় সরকার। কিন্তু একে সমস্যার সত্যিকারের সমাধান হয় না। আমি ভবিষ্যতের কথা ভাবি, মৌলবাদী অপশক্তির অবসান চাই। অবসান ফাঁসি দিয়ে হয় না, এই অবসান সুশিক্ষা দিয়ে করতে হয়।
সমাজকে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, নারীবিদ্বেষ থেকে মুক্ত করতে হলে মানুষকে শিশুকাল থেকেই শিক্ষা দিতে হবে বিজ্ঞান, মানববাদ, সমানাধিকার। এই শিক্ষা পেলে শিশুদের ধর্মান্ধ, ধর্ষক আর খুনী হওয়ার আশংকা থাকে না।
জামাতে ইসলামির লোকেরা যে ভয়ংকর বর্বরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশে, তা দেখে আমি অবাক হইনি। কারণ আমি অনেক বছর থেকেই জানি যে জামাতে ইসলামি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত হলেও এটি একটি সন্ত্রাসী দল ছাড়া কিছু নয়। এদের রাজনীতি ঘৃণার, বৈষম্যের, অন্ধত্বের, অকল্যাণের, পঙ্গুত্বের, হত্যার। এই রাজনীতিকে সমাজে প্রবেশের করার সুযোগ দিলে এই রাজনীতি মানুষকে, দেশকে, দেশের ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে দেবে। খুব সংগত কারণেই জামাতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত। পৃথিবীর সব দেশেই সন্ত্রাসী দল নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করতে গেলে ‘গেল রে গেল রে’ বলে ছুটে এসে বাধা দেয় অনেকেই। যে দল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, সেই দলকে গণতন্ত্রের নামে বাঁচিয়ে রাখবো আর হাসতে হাসতে সে আপনার রগ কাটবে, আমার গলা কাটবে—এ আমরা জানি। জেনেও না জানার ভান আর কেউ করলেও আমি করি না। বাংলাদেশকে একটা ধর্মীয় মৌলবাদীতে ঠাসা, অনুন্নত, অশিক্ষিত, ধর্মান্ধ দেশ হিসেবে তৈরী করার বাসনা দেশের এবং দেশের বাইরের অনেকেরই যথেষ্ট। আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় প্রচণ্ড বিশ্বাসী হয়েও একটি দলকে নিষিদ্ধ করতে চাইছি, কারণ জামাতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য নয়।
যুদ্ধপরাধীরা প্রায় সবাই ইসলামী মৌলবাদী। মৌলবাদী-যুদ্ধপরাধী বা ইসলামী মৌলবাদীদের খুব বড় শত্রু আমি। তারা আমাকে খুন করার জন্য আজ একুশ বছর হলো ছুরিতে শান দিচ্ছে। হাতের কাছে পেলেই আমাকে জবাই করবে। এটা জেনেও আমি কিন্তু ওদের কারো ফাঁসি চাইছি না। ওরা ভালো মানুষ হোক, চাইছি। ওদের সন্তানেরা প্রগতির পক্ষের মানুষ হোক, চাইছি। ওদের সন্তানের সন্তানেরা যেন না জানে ধর্মান্ধ মৌলবাদ কাকে বলে, যেন সবাই একটা শ্রেণীহীন, বৈষম্যহীন, কুসংস্কারহীন সুন্দর পরিবেশ পায় বাস করার। সব মানুষ, এবং সব সন্তানই যেন পায়। সেই স্বপ্নের জন্য লড়াই আমার। আমি ওই সমতার সমাজ বেঁচে থাকতে দেখতে পারবো না, কিন্তু আমি সামান্য ভূমিকা রাখতে চাই সেই সুস্থ সমাজ গড়ায়, তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েও লিখছি, মানুষকে লড়াই করার প্রেরণা দিচ্ছি। যে দেশকে আজ দেশ বলে মনে হয় না, যে দেশ নিয়ে আজ লজ্জা হয়, চাইছি, সেই দেশ নিয়ে ভবিষ্যতের মানুষেরা গর্ব করুক। রক্তাক্ত রাজপথ নিয়ে নয়, একটি নিরাপদ স্বদেশ নিয়ে গর্ব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন