উদ্বেগজনকহারে বাংলাদেশে বাড়ছে অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশীর সংখ্যা। বিদেশী নাগরিকদের বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য ভিসা দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা দেশে কতদিন থাকছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছেন সেসব দেখার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। কোনো বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করতে চাইলে তাকে ওয়ার্ক পারমিট নিতে হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বিনিয়োগ বোর্ড থেকে। কর্মক্ষেত্রে তার সুযোগ-সুবিধা দেখার দায়িত্ব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের। আর এ দেশে কাজ করে বিদেশি যে অর্থ উপার্জন করে তা থেকে আয়কর আদায় করার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। অথচ দেশে কতজন বিদেশি নাগরিক রয়েছে সে তথ্য জানে না এসব মন্ত্রণালয় কিংবা বোর্ডের কেউই।
২০১৫ সালের শেষের দিকে রাজধানীর গুলশান ও রংপুরে দুইজন বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশে অবস্থানরত বিদেশিদের তালিকা তৈরির একাধিক উদ্যোগ নেয়া হলেও তার কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তার প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে অন্তত ১২ লাখ বিদেশি নাগরিক রয়েছে, যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। বিদেশীদের কর্মসংস্থানের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে তৈরী পোশাক শিল্প খাত।
কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, স্যুয়েটার ফ্যাক্টরি, বায়িং হাউজ, মার্চেন্ডাইজিং কোম্পানি প্রভৃতিতে কাজ করছে প্রায় ১০ লাখ বিদেশী। এছাড়া বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার স্টেশন, আন্তর্জাতিক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউজ, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান, মোবাইলফোন কোম্পানি, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, নানা ধরনের পার্লার এমনকি শোরুমের কর্মচারী হিসেবেও কাজ করছে অনেক বিদেশী। এদের বেশির ভাগই ভারতীয়। এ ছাড়া রয়েছে শ্রীলঙ্কা, চীন, জাপানসহ আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকার নাগরিকও।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এদেশে কর্মরত বিদেশীদের বেশির ভাগই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে কর্মসূচি বাস্তবায়ন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসব বিদেশী। বেতন-ভাতা হিসেবে তাদের একজন যা পায় তা দিয়ে সমপদে তিন থেকে ১০ জন বাংলাদেশী নাগরিককে পদায়ন করা সম্ভব হলেও অনেক উদ্যোক্তার কাছে এটি একরকম ‘ফ্যাশন’ বা ‘স্ট্যাটাস’।
আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশাকে প্রাধান্য দিতে কিংবা যোগ্য লোকের অভাবের অজুহাতেও কেউ কেউ বিদেশীদের নিয়োগ দিয়ে থাকে বলে জানা যায়। অভিযোগ রয়েছেন উচ্চ বেতনে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত এসব বিদেশি অনেক ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক শিল্প খাতে অসন্তোষ সৃষ্টিসহ বহু অপরাধের সাথে যুক্ত। নামকরা বহু তৈরি পোশাক কারখানা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের কাছে বিক্রি করে দেয়ার ক্ষেত্রে এদের হাত আছে বলেও জানা গেছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বিনিয়োগ বোর্ডের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে ১২ হাজারের মতো বিদেশি। যদিও এদের অনেকেই একবার অনুমতি নিয়ে আর নবায়ন করেনি। অভিযোগ রয়েছে, তালিকাভুক্তরাও ঠিকমতো আয়কর দেয় না। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে কেউ কেউ মনগড়া একটি আয়কর রিটার্ন দাখিল করলেও লোক দেখানো এ কাজটিও করছে না লাখ লাখ বিদেশী।
এনবিআরের কাছে বিদেশীদের সম্পর্কে যে তথ্য আছে তাতে কর ফাঁকি দিয়ে দেশে কাজ করা বিদেশির সংখ্যা অন্তত পাঁচ লাখ। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে যে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে কিংবা আমাদের পোশাক শ্রমিকদের হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের বিনিময়ে যে পোশাক তৈরি হয়ে বিদেশে রফতানী হচ্ছে তার বিপরীতে আসা অর্থ অনায়াসেই বাইরে নিয়ে যাচ্ছে এসব বিদেশি। বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক বিদেশি। নাগরিকের অবৈধভাবে অবস্থান যেকোনো বিবেচনায় উদ্বেগজনক। মাদক ও সোনা চোরাচালান, জাল টাকা তৈরি ও বিপণন, অবৈধ অস্ত্র ও ভিওআইপি ব্যবসা এবং জালিয়াতির সঙ্গে বিদেশীদের ব্যাপকহারে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকার পরও তাদের উপর কড়া নজরদারির ব্যবস্থা না করা দায়িত্বহীনতার নামান্তর।
বিদেশীদের একাংশ সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িত বলেও সন্দেহ করা হয়। এজন্য ভরত-পাকিস্তান এবং আফ্রিকার কোনো কোনো দেশের নাগরিককে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতার করাও হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িতসহ জাল টাকা তৈরিতেও ব্যাপকভাবে যুক্ত বিদেশীরা। তবে রহস্যজনক কারণে ভারতীয় অবৈধ নাগরিক বা ভারতীয় অপরাধীদের ক্ষেত্রে সবসময়ই নমনীয় সরকারি মহল; যা দেশের জন্য চরম উদ্বেগজনক।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বিভিন্ন অপরাধে দেশের কয়েকটি কারাগারে সাজা খাটছে প্রায় ৫শ’ বিদেশী। এর বাইরে, সাজা শেষ হওয়া প্রায় হাজারখানেক বিদেশীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে গিয়ে জটিলতায় পড়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে এদেশে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করছে এসব বিদেশির।
বিদেশি নাগরিকদের অবৈধভাবে অবস্থান এবং অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হওয়া আইন-শৃঙ্খলার জন্য হুমকি সৃষ্টি করলেও এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো কতটা সচেতন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
সরকারের উচিত- এমন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া যাতে বিদেশীদের পক্ষে অবৈধভাবে চাকরি ও বসবাস করা সম্ভব না হয়। এজন্য মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত ও জোরদার করতে হবে। কতজন বিদেশী আসছে, তারা ঘোষিত উদ্দেশ্যের বাইরে অন্য কোনো কাজ- বিশেষ করে চাকরি করছে কিনা এসব বিষয়ে মনিটরিং থাকতে হবে। ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে যারা বাংলাদেশে আসছে তাদের কাউকে কোনো চাকরিতে ঢুকতে দেয়া যাবে না; বরং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বহিষ্কার বা গ্রেফতার করতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগের অনুমতি দেয়ার সময়ও শর্ত রাখা দরকার- যাতে স্থাপিত শিল্প বা প্রতিষ্ঠানে চাকরি প্রধানত বাংলাদেশীরাই পেতে পারে।
উল্লেখ্য, দেশের বেকারদের প্রতি কর্মসংস্থানের সুযোগ না দিয়ে কেবলমাত্র গাফলতি ও অবহেলার জন্য বিদেশীদের বিশেষত ভারতীয়দের এভাবে বিচরণ ও সুবিধা হাছিলের সুযোগ করে দেয়ার নজির বিশ্বের কোথাও নেই। এর আগেও এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছিল। সরকার যদি এ গাফলতির ইতি না টানে, তবে এখন জনগণকেই সোচ্চার হয়ে তার অবসান ঘটাতে হবে। আলোক চিএ সাকিব আহমদ মুছা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন