মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০১৬

বাংলাদেশ জিহাদীদের থাবার নীচে - ব্লগার সাংবাদিক সাকিব আহমদ মুছা

সম্পাদক নোট: ব্লগার সাংবাদিক সাকিব আহমদ মুছার ‘বাংলাদেশ জিহাদীদের থাবার নীচে’ প্রবন্ধটি তার নিজ ওয়েবসাইট থেকে প্রকাশ করা হলো।

 খুন ও হামলা


গত ২৪ অক্টোবর শনিবার গভীর রাতে মুহর্‌রম উপলক্ষ্যে শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি চলাকালে বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা দুই আর শিশুসহ আহত হয়েছে দেড় শতাধিক যাদের কয়েকজন এখনও হাসপাতালে। একদিকে যখন চলছে লেখক ও প্রকাশকদের উপর হামলা এবং ঘটেছে শিয়াদের উপর বোমা হামলা তখন দেখা যাচ্ছে পুলিশও এই হামলার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। অল্পকিছু দিন আগে গাবতলীতে পুলিশের উপর হামলা ও হত্যার পর সাভারের আশুলিয়ায় ছুরি ও চাপাতির আঘাতে একজন পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা ও অপরজনকের কুপিয়ে জখম করা হয়। এর মধ্যে আবার দুই বিদেশী নাগরিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একজন ইতালীর, অপরজন জাপানের নাগরিক।

পুলিশের উপর হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুমান করা যেতে পারে যে এগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করা বা তাদের মনোবল ভেঙ্গে ফেলা। কিন্তু শিয়াদের উপর হামলা? সেটা কারা করতে পারে? সহজ কারণে আঙ্গুলের ইশারা যায় কোনও অজ্ঞাত সুন্নী মুসলমান গোষ্ঠীর দিকে। সেটার উদ্দেশ্য কি রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করা? নাকি, এটার উদ্দেশ্য প্রধানত ধর্মীয়? যে কারণে ইতিপূর্বে কয়েক জন পীর ও পীরের অনুসারী এবং ইসলাম ধর্মীয় শাস্ত্রবিদকে তাদের ধর্মীয় অনুশীলন এবং ইসলাম সংক্রান্ত ব্যাখ্যার জন্য হত্যা করা হয়েছিল বলে সন্দেহ করা হয়। তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে, এক বা একাধিক শক্তিশালী গোষ্ঠী কিছু সংখ্যক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, যাদের উদ্দেশ্য একই সঙ্গে দুইটি হতে পারে, যে দুইটির একটি হচ্ছে ধর্মীয় ̶ অর্থাৎ মুসলমান নয় অথবা ধর্মবিশ্বাসমুক্ত কিংবা ইসলাম সংক্রান্ত তাদের ব্যাখ্যার সঙ্গে যাদের ব্যাখ্যা মিলে না তাদেরকে হত্যা ও নির্মূল করা, অপরটি হচ্ছে রাজনৈতিক ̶ রাষ্ট্রকে তাদের লক্ষ্য সাধনের জন্য অস্থিতিশীল করা।

এটা খুব লক্ষ্যণীয় যে, এই ধারাবাহিকভাবে লেখক ও ব্লগার বা অনলাইন এক্টিভিস্টদের উপর আক্রমণের সূচনা হয়েছে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি এবং ফাঁসীর দাবীতে শাহবাগ চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের পর। এই যুদ্ধাপরাধীরা ছিল প্রধানত জামাতের নেতা-কর্মী। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের জাতিদ্রোহী ও দেশদ্রোহী ভূমিকা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের কঠোর শাস্তির দাবীতে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ গণজাগরণ মঞ্চের পিছনে জমায়েত হল তখন দেখা গেল একেবারে সামনে না এলেও মুক্তচিন্তার লেখক ও ব্লগারদের খুব বড় অংশ গণজাগরণ মঞ্চের যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বস্তুত এই আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল ব্লগ ও ফেসবুকে অনলাইন লেখক ও ফেসবুক ব্যবহারকারীদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে। এটা এ দেশের আন্দোলনে এক সম্পূর্ণ নূতন ধারার সংযোজন ঘটায়। কারণ ব্লগ ও ফেসবুকের মত অনলাইনে লেখালেখি ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সূচনা ঘটে, যা এ দেশে অতীতে কখনও ঘটে নাই। এবং আন্দোলনের শুরুটা হয় তখন যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুরুতর অপরাধী মীরপুরের কসাই খ্যাত কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। শাহবাগ আন্দোলনের চাপে কাদের মোল্লার রায় পরিবর্তন করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছিল ’৭১-এর উত্তরাধিকার ধারণকারী জনমতের এক বিরাট বিজয়।

এই আন্দোলনের সময় জামাতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিএনপি এবং তার নেতা খালেদা জিয়াও গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে নাস্তিকদের আন্দোলন হিসাবে আখ্যায়িত করে তার বিরোধিতা করেন। এভাবে বিএনপি এ দেশের স্বাধীনতা বিরোধী এবং ধর্মান্ধ শক্তির সঙ্গে একীভূত শক্তি হিসাবে নিজেকে দেশবাসীর সম্মুখে চিহ্নিত করে। স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকার তার সুযোগ নিয়েছে। এখন তা তার প্রধান শত্রু বিএনপি-এর উপরও আজ অবধি সংঘটিত এ ধরনের প্রায় সব হত্যা-হামলার দায়ভার চাপানোর সহজ পথ বেছে নিয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে ইসলামবাদীদের আক্রমণগুলি অনেক প্রবল এবং সুসংগঠিত ভাবে পরিচালিত হচ্ছে বলে বুঝা যায়। ব্লগ লেখক আসিফ মহিউদ্দিন বা গ্রন্থ প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের মত ভাগ্যবানেরা গুরুতরভাবে জখম হয়ে বেঁচে গেলেও আহমেদ রাজীব হায়দার বা অভিজিৎ রায়ের মত লেখকরা বাঁচতে পারেন নাই। রাজীব হায়দার লিখতেন থাবা বাবা ছদ্মনামে। তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ীতে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং খ্যাতনামা মুক্তচিন্তার লেখক অভিজিৎকে হত্যা করা হয় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারীতে।

মুক্তচিন্তার উপর আক্রমণ অবশ্য সাম্প্রতিক নয়। অনেক কাল আগে ১৯৯৯ সালের জানুয়ারীতে ইসলামী জঙ্গী সংগঠন হরকাত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামী মুক্ত বা উদার চিন্তার জন্য কবি শামসুর রহমানকে হত্যার জন্য আক্রমণ করলেও তিনি বেঁচে যান। আরও পরবর্তী সময়ে ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৪-এ লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমণের পর একটা দীর্ঘ বিরতি গিয়েছিল। ঐ আক্রমণের ফলে অল্প কিছুদিন পর তার মৃত্যু হয়। এটা সহজে বুঝা গিয়েছিল মৌলবাদী মুসলমানরা ঐ আক্রমণ বা হামলার পিছনে ছিল। তবে তার উপর হামলা ও খুনের কোনও বিচার এ দেশে হয় নাই।

সম্প্রতি কিছু কাল ধরে বাংলাদেশে ইসলামবাদীদের দ্বারা এমন কিছু গুপ্ত হামলা ও হত্যা সংঘটিত হয়েছে যেগুলির ধরন এবং টার্গেট দেখে এগুলির ইসলামী উৎস ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা করা যায়। বুঝা যায় খুনীদের বা হামলাকারীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু মুক্তচিন্তার লেখক, ব্লগার ও প্রকাশক এবং অতঃপর মূল ইসলামী ধারা বিচ্যুত মুসলমানরা এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা।

বিজ্ঞানমনস্ক ও ধর্মীয় প্রশ্নে মুক্তচিন্তার অধিকারী হিসাবে পরিচিত বেশ কয়েক জন লেখক, ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টকে সাম্প্রতিক কালে হত্যা অথবা হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা ও জখম করা হয়েছে। কয়েকজন মুক্তচিন্তার লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্টকে হত্যার পর সেই তালিকায় এখন যুক্ত হল মুক্তচিন্তার বই প্রকাশকও। হত্যার এই ধারায় গত ৩১ অক্টোবর, ২০১৫-তে দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকার শাহবাগের নিকটবর্তী জনাকীর্ণ আজিজ মার্কেটের নিজ অফিসে খুনীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপন। একই দিনে প্রায় একই সময়ে ঢাকার লালমাটিয়ার নিজ অফিসে প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল ছুরি, চাপাতি ও পিস্তল ধারী হামলাকারীদের দ্বারা আক্রান্ত ও গুরুতর আহত হয়েও বেঁচে গেলেও তিনি এখন হাসপাতালে। তার সঙ্গে আহত হয়েছেন সঙ্গে বসে থাকা আরও দুইজন লেখক। আহতদের সংখ্যা বাদ দিলেও গত আড়াই বছরে সারা দেশে নিহত মুক্তচিন্তার লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকের সংখ্যা এখন সাত।

এবার আসা যাক লেখক ও প্রকাশকদের ব্যাপারে। এটা স্পষ্ট যে প্রকাশকরা স্বঘোষিতভাবে ধর্মে অবিশ্বাসী কিংবা নাস্তিক হিসাবে পরিচিত না হলেও যারা নিহত হয়েছেন অভিজিৎসহ সকল লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট তা-ই। তারা সবাই নিজেদেরকে যুক্তিবাদী ও নিরীশ্বরবাদী হিসাবে দাবী করেছেন এবং ধর্মীয় অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাদের তীক্ষ্ণধার লেখা অনেকের পরিচিত। এদের হত্যার সঙ্গে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্য কতটা সম্পৃক্ত সেই প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই করা যায়। বরং সহজেই সন্দেহের তীর নিক্ষিপ্ত হয় জিহাদী তথা জঙ্গী ইসলামী গোষ্ঠীর প্রতি, যারা জিহাদের অংশ হিসাবে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন ও নিস্তব্ধ করার জন্য কাপুরুষোচিতভাবে এইসব গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। হতে পারে যে তাদের লক্ষ্য এইসব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাতে তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে এখানে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

এইসব হত্যা ও হামলার কি কোনও নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা বিন্যাস বের করা যায়? এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। কারণ তাহলে যেসব দেশী বা বিদেশী শক্তি এইসব হত্যা ও হামলার পিছনে ক্রিয়াশীল থাকতে পারে তাদের সম্পর্কে একটা ধারণা পাবার চেষ্টা করা যায়। তাতে পুরা সত্যকে ধরা না গেলেও কিছুটা কাছাকাছি একটা জায়গায় যাওয়া যেতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন