শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬

জঙ্গিবাদী নাগিনীর দংশনে ক্ষতবিক্ষত

সাকিব আহমদ মুছা, প্যারিস (ফ্রান্স) থেকে :–আবারও চাপাতির আঘাতে (২০ মে, শুক্রবার) খুন  কুষ্টিয়ার হোমিও চিকিৎসক মীর সানাউর রহমান। আহত হলেন তার বন্ধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুজ্জামান। মোটরসাইকেলে করে যাওয়ার সময় তারা আক্রমণের শিকার হন।

তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাংবাদিক কাজলের সূত্রে জানা গেল, উভয় ব্যক্তি বাউল ভক্ত এবং সর্বধর্ম সমন্বয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে দেখতেন। তারা প্রায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। রামকৃষ্ণ মিশনে যেমন যেতেনে তেমনি দেশে কিংবা দেশের বাইরের ধর্মীয় স্থানগুলোতে ঘুরে বেড়াতেন। স্রষ্টার পৃথিবীকে জানার অদম্য বাসনা ছিল তাদের। এ কারণে সময় পেলেই ছুটে যেতেন নানান জায়গায়। লোকায়ত ধর্ম-দর্শন আর আধ্যাত্ম জীবন ছিল তাদের অনুধ্যানের বিষয়। ব্যক্তি জীবনে কারো সঙ্গে তাদের শত্রুতা কিংবা জমি-জায়গা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল না। মতাদর্শগত সংঘর্ষও হয়নি কারো সঙ্গে। তাহলে হত্যাকাণ্ড কেন?

ব্লগার, সাংবাদিক, লেখক, প্রকাশক, হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ধর্মীয় পুরোহিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, ভিন্ন মতের ইসলামী ভাবধারার অনুসারী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও বিদেশিদের ওপর একের পর এক বর্বর হামলার সঙ্গে এই চাপাতির কোপের সাদৃশ্য রয়েছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক হত্যার এই ‘চক্র’ভাঙার আহ্বান জানিয়ে সরকারের উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় মিশনগুলোর প্রধানরা ২২ মে বলেছেন, এই ধরনের হামলা চলতে থাকলে তা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। এসব হামলা মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রতি ‘নজিরবিহীন হুমকি’তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করেন তারা। আর এ ধরনের ঘটনা মুক্ত, সহনশীল এবং স্থিতিশীল ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পরিচয় মুছে দিতে পারে।

এসব হামলার অনেকগুলোতে দায় স্বীকার করে আইএস ও আল-কায়েদার নামে বার্তা এলেও সরকার বলছে, অভ্যন্তরীণ জঙ্গিরাই এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের মতে, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ‘ক্ষুণ্ন’ এবং সরকারকে সমস্যায় ফেলতে জামায়াতে ইসলামী ও এর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার খুনের পর থেকে টাঙ্গাইলে হিন্দু দর্জি নিখিল জোয়ারদার হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ৩৭টি হামলার মধ্যে ২৫টি জেএমবি, আটটি আনসারউল্লাহ বাংলা টিম ও চারটি ঘটনা অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠী ঘটিয়েছে। অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠী যেমন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি), আনসার আল-ইসলাম, আনসারল্লাহ বাংলা টিম, হরকাতুল-জিহাদ-আল-ইসলাম (হুজি-বি), হিজবুত তাহরির বাংলাদেশ এবং নতুন আবির্ভূত আল মুজাহিদ প্রভৃতি এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত। হামলা ও হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৩৪টিরই মূল রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে বলে দাবি করেন পুলিশপ্রধান। এর মধ্যে মাত্র ছয়টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

কুষ্টিয়ার হত্যাকাণ্ডের ধরনের সঙ্গে ২০১৩ সাল থেকে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলোর মিল রয়েছে। যারা এসবের শিকারে পরিণত হচ্ছেন, তাদের মধ্যেও বৃহত্তর পরিসরে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। তারা হয় ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন মতাদর্শের বা ভাবধারার অথবা জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অথবা সাংস্কৃতিকভাবে সক্রিয়। ফলে এটা ধরে নেওয়া খুবই সংগত যে পরিকল্পিতভাবেই এসব ঘটনাগুলো ঘটছে এবং এসবের পেছনে সংগঠিত শক্তি রয়েছে। আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত তরুণ প্রজন্মের অনেকেই আজ জঙ্গিবাদী নাগিনীর দংশনে ক্ষতবিক্ষত। খুন করা হয়েছে ৩৭ জনকে, খুনের হুমকি রয়েছে শতাধিক মানুষের মাথার ওপর। ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৫ জন ব্লগারকে তাদের লেখালেখির কারণে হত্যা করা হলেও ওই মামলাগুলোর খুব বেশি অগ্রগতি নেই।

আহমেদ রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায় ও ওয়াশিকুর রহমান এবং অনন্ত বিজয় দাশ ও নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় এবং জুলহাস, তনয়, নলিয় অথবা নাজিমের জন্য আমরা এ পর্যন্ত কিছুই করতে পারিনি। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। খুন করেছে আজিজ সুপার মার্কেটের জাগৃতি প্রকাশনীর তরুণ প্রকাশক দীপনকে। অন্যদিকে ব্লগারদের মতো একই কায়দায় একইদিন হামলার শিকার হয়েছেন অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের কর্ণধর আহমেদুর রশীদ টুটুল। টুটুলের সঙ্গে আহত হয়েছেন ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসু।

ফেব্রুয়ারিতে(২০১৫) অভিজিৎ নিহত হওয়ার পর ফেসবুকে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়ে ব্লগার সাংবাদিক সাকিব আহমদ মুছা ছাতক থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। উল্লেখ্য, বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’সহ কয়েকটি বই বের করেছে শুদ্ধস্বর। অভিজিৎ খুনে যেমন ৪/৫ জনের দল পরিকল্পিতভাবে কাজ করেছিল ঠিক একইভাবে এই হামলাকারীরা ছিল পাঁচজন। তারা ঢুকেই বলেছিল, ‘আমরা টুটুলকে মারতে এসেছি।’ অফিসে ঢুকে কুপিয়ে তালা মেরে চলে গেছে তারা। এসব ক্ষেত্রে নিহতদের দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করা হয়েছে। প্রত্যেককেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রত্যেকটি ঘটনার পরই ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনের নামে দায় স্বীকার করা হয়েছে।

গত বছর (২০১৫) মে মাসে একাধিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জেনেছি তালিকা ধরে ধরে ব্লগার খুন করা হচ্ছে। সরকারের কাছে দেওয়া কথিত ‘নাস্তিক তালিকা’অনুযায়ী একের পর এক ব্লগারকে হত্যা করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তালিকাটি থাকলেও ব্লগারদের নিরাপত্তায় কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। আনজুমানে আল বাইয়্যিনাত নামের একটি সংগঠন ‘নাস্তিকদের তালিকা’শিরোনামে ৫৬ জনের একটি তালিকা তৈরি করে। এই ৫৬ জনের মধ্যে আবার ২৭ জনকে আলাদা করা হয়।

জামায়াত-শিবির পরিচালিত একটি ফেসবুক গ্রুপের নাম ‘বাঁশের কেল্লা’। একই সময়ে সেখানে ৮৪ ব্লগারের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। ওই তালিকায় আগের ৫৬ জনের নামও ছিল। আনজুমানে আল বাইয়্যিনাতের তালিকায় রাজিব হায়দার ওরফে শোভনের নাম ছিল। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাকে হত্যা করা হয়। এরও আগে ১৪ জানুয়ারি তালিকায় নাম থাকা আরেক ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এর পরে অভিজিৎ রায়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর ঠিক একই কায়দায় হত্যা করা হয় মূলত ফেসবুকে লেখালেখি করা ওয়াশিকুর রহমানকে। তবে কোনো তালিকাতেই ওয়াশিকুরের নাম ছিল না। সবশেষে ১২ মে সিলেটে হত্যা করা হয় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে। আনজুমানে আল বাইয়্যিনাতের তালিকায় তার নামটি ছিল।

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর জঙ্গিদের চাপাতি হামলার পর রাজিব হায়দারকে চাপাতির আঘাতে খুন করা হয় ২০১৩ সালে। ব্লগে লেখালেখির কারণে বাংলাদেশে প্রথম কোনো হত্যাকাণ্ড এটি। মুক্তমনা নামে ব্লগ সাইটের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কেও গতবছর ২৬ ফেব্রুয়ারিতে সস্ত্রীক বাংলা একাডেমির বইমেলা দেখে ফেরার পথে চাপাতির আঘাতে প্রাণ হারান। তার স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদও মারাত্মক আহত হন। অভিজিৎ রায়কে হত্যার এক মাসেরও কম সময়ের মাথায় ৩০ মার্চ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে ঢাকার তেজগাঁও এলাকার একটি সড়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা করা হয় গত ১২ মে, সিলেটে। ঢাকার বাইরে এটাই একমাত্র ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।

অনন্ত বাসা থেকে বের হয়ে একটি ব্যাংকে যাবার পথে হামলার শিকার হন। তিনি মুক্তমনা ব্লগে লিখতেন এবং সিলেট থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। গত ৭ আগস্ট দুপুরে রাজধানীতে বাড়িতে ঢুকে হত্যা করা হয় ব্লগার নীলকে। ২৫ এপ্রিল(২০১৬) সমকামী মানবাধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নান এবং তার বন্ধু মাহবুব রাব্বি তনয়কে ঢাকার কলাবাগানের এক বাসায় কুপিয়ে হত্যা করে অজ্ঞাতনামা একদল লোক। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সিলেটের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। অন্যদিকে ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তারও আগে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে।  

এসব ঘটনায় আমরা এখন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে ভয়াবহ দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। যারা এসব ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে, পরিকল্পনা পর্যায়ে তাদের চিহ্নিত করা অথবা ঘটনা ঘটে গেলে তাদের ধরে বিচারের মুখোমুখি করা না গেলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। পরিস্থিতি আরও খারাপ ও নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার আগেই আমরা এ ব্যাপারে সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ আশা করছি। সরকারের মন্ত্রীদের কথা অনুসারে, বাংলাদেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন ‘স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ’। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে এবং ‘ঝুঁকিতে’থাকা সব নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার অঙ্গীকারও সরকারের আছে।

‘সহিংসতার এই চক্র’ ভাঙার জন্য পরিকল্পিত এবং সমন্বিত কর্মসূচি দরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান নিয়মিত হওয়া প্রয়োজন। জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সমন্বিত পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গণতান্ত্রিক আচরণ, জবাবদিহিতা, বাক স্বাধীনতা, শক্তিশালী গণমাধ্যম, সহনশীলতা বৃদ্ধি এবং সুশীল সমাজের ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যদিকে যে কোনো ধরনের সন্ত্রাস ও চরমপন্থিতার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ ফলপ্রসূ করার জন্য সকলের নিরাপত্তা দিতে বদ্ধপরিকর হতে হবে। সংসদের বাইরে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি জঙ্গিবাদ দমনে কার্যকর সহযোগিতা প্রদান করতে পারে।

যদিও ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পাস হওয়া প্রস্তাবে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার যে আহ্বান জানানো হয় তাতে কর্ণপাত করেনি দলটি। তবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় তাদেরও দায়িত্ব আছে। ধর্মীয় উগ্রবাদিতাকে প্রত্যাখ্যান করে জনজীবনকে নিরাপদ করতে বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দল সহায়তা করবে এবং জঙ্গিবাদীদের শেকড় উপড়ে ফেলবে- চাপাতির কোপ আজকের এই দিনটি থেকে বন্ধ হোক এই প্রত্যাশা আমাদের। আমরা নির্বিঘ্নে বইয়ের পাতা উল্টাতে চাই এবং মুক্ত বুদ্ধির চর্চায় নিজেকে প্রকাশ করতে চাই নির্ভয়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন