শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬

‌’নারী’—এড. শাকী শাহ ফরিদী

“এ জগতে যা কিছু মহান চির কল্যানকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধের তার নর”। কবিতার পংক্তিতে কবির এমন সরল ও সত্য স্বীকারোক্তি নারীদের সুমহান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে বটে, তবে পারিবারিক, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনে নারীরা আদৌ কতটুকু নিরাপদ তা এখনো তর্কের বেড়াজালে বন্দি। যে পরিবারে একটি মেয়ে শিশুর বেড়ে ওঠা, সেখানেও অনেক সময় নিকটাত্মীয় কারো কাছেই যে নিগ্রহ-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পরিবারের বাইরে একটি কন্যা শিশুর দ্বিতীয় পৃথিবী হলো তার শিক্ষাঙ্গন। একশ্রেণীর মূল্যবোধ বিবর্জিত শিক্ষকের কাছে কোমলমতি মেয়ে শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে হর-হামেশা। বিদ্যাশিক্ষার প্রাথমিক অঙ্গন থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপিট পর্যায়েও “যৌন হয়রানি” নামক ভয়াল থাবার শিকার নারী ও শিশু। অতঃপর অর্জিত শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে কর্মজীবনে পদার্পন, স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের পথে যাত্রা।সেই যাত্রাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অফিস-বস বা উর্ধবতন কর্মকর্তার লোলুপ দৃষ্টিতে, পদমর্যাদার উন্নতির ক্ষেত্রে তো বটেই,চাকুরী পাওয়া এমনকি চাকুরী টিকিয়ে রাখতেও ক্ষেত্র বিশেষ ধরণা দিতে বাধ্য করা হয় নারীকে। লালসার শিকারে পরিণত হওয়া চাকুরীজীবী নারীদের ক্ষেত্রে জীবনের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। কবির পংক্তিদ্বয় কি তাহলে শুধুই তাত্ত্বিক? সমাজের একটি বিশাল অংশ জুড়ে এখনো গোড়ামি দৃষ্টিভঙ্গির জোড়ালো অবস্থান বিদ্যমান। নারী বা কন্যা শিশু সেখানে অবহেলিত, গৃহস্থালীর কর্ম সম্পাদনেই তাদের জীবন যাপন করানোর তাগিদ সেখানে প্রকট; আধুনিক শিক্ষা বা প্রযুক্তির সাথে নারীকে পরিচয় করাতে সেখানে বড্ড অনীহা, নারীকে স্বাধীনতা দেয়া সেখানে অতিমাত্রার বাড়াবাড়ি বলে বিবেচিত। নারীর অগ্রযাত্রা রোধে প্রতিবন্ধক নয় কি এগুলো? রাস্তাঘাটে অবাধে চলাফেরা, শপিং মল কিংবা গন-পরিবহন সর্বত্রই ভালো মানুষের ভীড়ে বখাটেদের উৎপাত। নৈতিকতা আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ে অবলীলায় চলে যৌন নিপীড়ন অথবা অশ্লীলতা। এগুলো দেখার কি কেউ নেই!? যাদের দেখার কথা তারা চোখ থাকিতে অন্ধ, মানবিক কারণে যারা দেখে, এগিয়ে যায়, প্রতিবাদ করে, তাদের ঠিকানা হয় পঙ্গু হাসপাতাল। নারীরা কি তবে অনিরাপদই থেকে যাবে? আইনের আশ্রয়, নারীবান্ধব নীতিমালা এগুলো কি শুধুই কাগজে কলমে? উল্লেখ্য, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ অ্যাকশন এইডের’ একটি জরিপ থেকে জানা যায়, যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার ৯৫ শতাংশ নারীই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চান না, তারা মনে করেন এতে সমস্যা আরো প্রকঠ হয়। এ জরিপ থেকে আরো জানা যায়, একা ঘরের বাইরে যেতে চান না ৬০ শতাংশ নারী। গনপরিবহন ও নির্জন স্থান এড়িয়ে চলেন ২৩ ও ২৬ শতাংশ নারী, এর মধ্যে ১৩ শতাংশ নারী গণপরিবহন ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন। এছাড়াও ৬৯ শতাংশ নারী দোকানের কর্মচারী বা বিক্রেতার অশ্লীল মন্তব্যের শিকার আর সবচেয়ে বেশী নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হন রাস্তাঘাটে বলে জরিপ উঠে আসে। জরিপে নারীদের ৭৬ শতাংশই বলেছেন তারা কোন না কোন ভাবে যৌন হয়রানীর শিকার। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর হার বেশি যা ৮৭ শতাংশ। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে ৭৬ শতাংশ আর মেডিকেল কলেজগুলোতে ৫৪ শতাংশ। (সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন। ০৫/১২/২০১৪ইং , শুক্রবার)। আশার কথা হচ্ছে এতকিছুর পরেও নারীদের সাফল্য থেমে নেই, এগিয়ে যাচ্ছে দেশ; ক্ষমতায়ন হচ্ছে নারীর। দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পীকারসহ স্থানীয় সরকারের প্রায় ১৪ হাজার নারী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন একাধিক নারী । কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের পুরষ্কার স্বরূপ দেশের প্রথম নারী বিচারপতি নির্বাচিত হয়েছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। এছাড়াও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক খালেদা ইকরাম। আর বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করা ওয়াসফিয়া নাজরীন ও নিশাত মজুমদারের কৃতিত্ব বিশ্বময় সবারই জানা। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে সামরিক নারী বৈমানিক হিসেবে সম্প্রতি পাইলট অফিসার তামান্ন-ই-লুৎফি প্রথমবারের মত একক উডডয়ন করেছেন, আর বাংলাদেশের প্রথম নারী প্যারাট্রুপার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌস। সালমা খাতুন ২০০৬ সালে প্রথম ট্রেন চালান কোন নারী হিসেবে। এছাড়া কর্পোরেট পেশায়ও নারীদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে দিন দিন। এখন প্রয়োজন শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো, নৈতিকতা আর মূল্যবোধ বৃদ্ধি, বিবেক জাগ্রত করা আর নারীদের শ্রদ্ধা-সম্মান দেয়ার মানসিকতা তৈরির দিকে সুনজর দেয়ার, পাশাপাশি গোড়ামি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে নারীকে ঘরের বাইরের পৃথিবী দেখার সুযোগ, শিক্ষা ও প্রযুক্তির সান্নিধ্য লাভের সহায়তা প্রদান, পুরুষ শাসিত মানসিকতা পরিত্যাগ, সর্বোপরি নারীর নিরাপত্তা প্রদানে সচেষ্ট হওয়া, যৌন হয়রানি কিংবা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো ইত্যাদি নারীর অগ্রাযাত্রাকে আরো বেশি তরান্বিত করবে। …শুভ হউক নারী দিবস… (এডভোকেট শাকী শাহ ফরিদী, চেয়ারম্যান,শাহ ফাউন্ডেশন।) সিলেট থেকে সাকিব আহমদ মুছা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন